কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, গীতিকার ও সুরকার। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
জন্ম: ২৪ মে, ১৮৯৯, চুরুলিয়া, ভারত
মৃত্যু: ২৯ আগস্ট, ১৯৭৬ (বয়স ৭৭ বছর), ঢাকা
"কাণ্ডারী হুশিয়ার" (সতর্ক হও, হে কাপ্তান), সর্বাধিক অনুপ্রেরণাদায়ক দেশপ্রেমমূলক গানগুলোর মধ্যে একটি, যা রচনা করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬), যিনি ছিলেন বাংলার বিদ্রোহী কবি এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি। "কাণ্ডারী হুশিয়ার" কবিতায় কবি জাতি, ধর্ম বা বর্ণের গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাবাদের উচ্চ মূল্যবোধগুলোকে বোঝার জন্য ভারতীয়দের আহ্বান জানান।এই কবিতায় তিনি গভীর আবেগের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেসের নেতাদের প্রতি আবেদন জানান যাতে তারা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের লক্ষ্যে আরও দৃঢ় সংকল্প নিয়ে কাজ করেন।
"কাণ্ডারী হুশিয়ার" কাজী নজরুল ইসলামের রচিত একটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা, যা তাঁর বিপ্লবী চেতনার প্রতিফলন ঘটায় এবং জাগরণ ও দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের আহ্বান জানায়।
এই কবিতাটি উজ্জ্বল চিত্রকল্প ও রূপকের মাধ্যমে তার মূল বার্তা প্রকাশ করে। এটি এক কাণ্ডারীর (নাবিক) উদ্দেশ্যে লেখা, যেখানে তাকে সতর্ক ও সচেতন থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, কারণ সমুদ্র অত্যন্ত প্রতারণাপূর্ণ ও বিপদসংকুল। এখানে সমুদ্র প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যা অস্থির ও অনিশ্চিত বিশ্বকে নির্দেশ করে, আর কাণ্ডারী হলো সাধারণ জনগণের প্রতিচ্ছবি, যারা জীবনের প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে পথ চলছেন।
নজরুল তাঁর কবিতায় ছন্দময় ভাষা ও গীতিময়তা ব্যবহার করে এক ধরনের তাত্পর্য ও তীব্রতা সৃষ্টি করেছেন। তিনি সতর্কতা ও সাহসিকতার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এবং কাণ্ডারীকে তার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরে রাখতে, প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি শক্ত হয়ে দাঁড়াতে এবং কখনোই হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ না করার নির্দেশ দিয়েছেন।
"কাণ্ডারী হুশিয়ার" কবিতার মাধ্যমে নজরুল সমাজের প্রতিটি মানুষকে আশেপাশের অন্যায় ও দুর্ভোগ সম্পর্কে সচেতন হতে আহ্বান জানান। তিনি তাদের অনুরোধ করেন যেন তারা দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন, প্রচলিত শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পান এবং নিজেদের অধিকার ও সম্মানের জন্য সংগ্রাম করেন।
সামগ্রিকভাবে, "কাণ্ডারী হুশিয়ার" এক অনুপ্রেরণাদায়ক কবিতা, যা নজরুলের বিপ্লবী আদর্শকে ধারণ করে। এটি মানুষকে সতর্ক, সাহসী ও ন্যায়বিচারের পথে অবিচল থাকার আহ্বান জানায়। কবিতাটি প্রতিরোধ ও জাগরণের চেতনা জাগিয়ে তোলে, যা নজরুলের অনেক সাহিত্যকর্মের মূল বৈশিষ্ট্য।
নজরুল শৈশব থেকেই মানবতার প্রতি গভীর ভালোবাসা লালন করতেন, কারণ তিনি এমন এক সমাজে জন্মগ্রহণ করেছিলেন যেখানে শ্রেণিবিভেদ, ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতাবাদ, শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচার এবং কুসংস্কার প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছিল প্রধান সমস্যা। নজরুল বলেন:
"ওরা হিন্দু না মুসলিম?
এই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ—
সন্তান মোর মা’র!"
হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ নজরুলকে অত্যন্ত ব্যথিত করেছিল। তিনি অনুভব করেছিলেন যে এই সমস্যার সমাধান না করা পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ভারতের সমস্ত জনগণ ও দেশীয় নেতাদের একত্র হয়ে নিজেদের হারানো সম্মান ও স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার জন্য কাজ করার আহ্বান জানান।
একজন দেশপ্রেমিক কবি হিসেবে তিনি মানুষের মধ্যে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে একতা গড়ে তোলার চেষ্টা করেন এবং সবাইকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
সমাজের অবিচার, নিপীড়ন, শোষণ ও নিষ্ঠুরতা দেখে নজরুল গভীরভাবে আহত হন। তিনি ভাবতে থাকেন যে দেশবাসীর জন্য কিছু করা দরকার। এই ভাবনা থেকেই তিনি "কাণ্ডারী হুশিয়ার" (সতর্ক হও, হে কাপ্তান) কবিতাটি রচনা করেন, যা একটি দেশপ্রেমমূলক সংগীত হিসেবে পরিচিত।
এই কবিতায় তিনি তরুণ প্রজন্মকে জাতীয় বিপদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার আহ্বান জানান, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ভুলে গিয়ে মানবতার উচ্চ মূল্যবোধগুলো উপলব্ধি করার জন্য অনুরোধ করেন। কবি বলেন:
"যারা গেয়েছিল জয় জীবনের
ফাঁসির কাঠের তলে দাঁড়িয়ে,
এসো, আজ সবে গোপনে মিলি
দাম কত তার, বলো বন্ধু,
দিয়েছ কী বলো বলি?"
নজরুল ও তার সাহিত্যকর্ম, বিশেষত "কাণ্ডারী হুশিয়ার" (সতর্ক হও, হে কাপ্তান), প্রেরণার এক বিরাট ভান্ডার। এই ধারাবাহিকতায়, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় এই গানটি আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
তাই, নজরুল ইসলাম নিছক একজন কবি নন, বরং একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক কবি।
You have to cross the darkness of the night
তোমাকে রাতের অন্ধকার পার হতে হবে।
A desert vast and a hill of great height,
এক বিশাল মরুভূমি এবং এক উচ্চ পর্বত অতিক্রম করতে হবে।
And an ocean, fathomless and dark.
এবং এক অতল, অন্ধকার সমুদ্র পার হতে হবে।
Travellers, beware and look sharp.
ভ্রমণকারী, সতর্ক হও এবং চোখ খুলে রাখো।
The boat is trembling,
নৌকা কাঁপছে।
The water is swelling,
পানি ফুলে উঠছে।
The sail is torn asunder,
পাল ছিঁড়ে গেছে।
And the boatman is losing his way,
আর মাঝি পথ হারিয়ে ফেলছে।
Who will sit at the helm at this hour?
এই মুহূর্তে কে হাল ধরবে?
Who has the courage and the power?
কার আছে সাহস ও শক্তি?
The future calls you,
ভবিষ্যৎ তোমাকে ডাকছে।
Come forward, all who are bold and true.
এসো সামনে, তোমরা যারা সাহসী ও সত্যনিষ্ঠ।
The night is dark, the storm is great,
রাত অন্ধকার, ঝড় প্রচণ্ড।
You must look sharp, there is no time to hesitate.
সতর্ক হও, সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।
You must make haste or it would be too late
তোমাকে দ্রুত হতে হবে, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।
To ferry the boat across the other side.
নৌকাকে অন্য পারে পৌঁছে দিতে হবে।
The night is dark, be your own guard.
রাত অন্ধকার, নিজেই নিজের রক্ষক হও।
You, soldiers of the country,
তোমরা, দেশের সৈনিকরা।
Age-old grievances have declared a fight,
বহুদিনের অন্যায় আজ লড়াই ঘোষণা করেছে।
The deprived heart is demanding its right.
বঞ্চিত হৃদয় তার অধিকার দাবি করছে।
You must take them along, the poor and the weak,
তোমাদের সাথে নিতে হবে গরিব ও দুর্বলদের।
You must make them strong, no longer mild and meek.
তোমাদের তাদের শক্তিশালী করতে হবে, যাতে তারা দুর্বল ও ভীত না থাকে।
You must lead them to victory.
তোমাকে তাদের বিজয়ের পথে নিয়ে যেতে হবে।
O Captain, my captain,
হে কাণ্ডারী, আমার কাণ্ডারী।
The helpless nation is going under water,
অসহায় জাতি পানিতে ডুবে যাচ্ছে।
It does not know how to swim.
এরা সাঁতার কাটতে জানে না।
I shall watch tonight
আমি আজ রাতে দেখব।
Your determination, grim yet bright,
তোমার দৃঢ় সংকল্প, কঠিন কিন্তু দীপ্তিময়।
To free the country from slavery.
দেশকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করার জন্য।
'Are they Hindus or Muslims?'
'ওরা হিন্দু না মুসলমান?'
Who asks this question, I say.
এই প্রশ্ন কে করছে, আমি জিজ্ঞাসা করি।
Tell him, my Captain,
তাকে বলো, হে কাণ্ডারী।
The children of the motherland are drowning today.
মাতৃভূমির সন্তানরা আজ ডুবে যাচ্ছে।
Doubts assail the mind of the travelers still,
ভ্রমণকারীদের মনে এখনো সন্দেহ ভর করছে।
There is thunder in the sky and danger over the hill.
আকাশে বজ্রপাত হচ্ছে, পাহাড়ের ওপরে বিপদ আসন্ন।
Captain, will you lose the way
কাণ্ডারী, তুমি কি পথ হারাবে?
And leave us in the lurch?
এবং আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলে যাবে?
You must not waver or sway,
তুমি দোদুল্যমান হতে পারবে না।
You must carry on the march.
তোমাকে এই যাত্রা চালিয়ে যেতে হবে।
Those who sang the victory of life
যারা জীবনের জয়ের গান গেয়েছিল।
With the noose of the gallows round their neck
যাদের গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো হয়েছিল।
Come and gather round quietly today.
তারা আজ নিঃশব্দে একত্রিত হোক।
What price do you pay for that, friends,
বন্ধুরা, তোমরা এর জন্য কী মূল্য দিচ্ছো?
What sacrifice do you make?
তোমরা কী ত্যাগ করছো?
It is a test, dear Captain,
এটি একটি পরীক্ষা, প্রিয় কাণ্ডারী।
Do you save the country or the caste at this hour?
তুমি কি দেশকে বাঁচাবে, নাকি জাতপাতকে?
The boat is trembling,
নৌকা কাঁপছে।
The water is swelling,
পানি ফুলে উঠছে।
Beware, my Captain, beware.
সতর্ক হও, হে কাণ্ডারী, সতর্ক হও!
এই কবিতাটি বিপ্লব, নেতৃত্ব ও জাতীয় ঐক্যের এক শক্তিশালী আহ্বান। এখানে সমুদ্র, ঝড় ও অন্ধকার রাত মানবজীবনের বিপদ, রাজনৈতিক সংকট ও শোষণের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। নৌকা ও কাণ্ডারী দেশ ও নেতাদের প্রতিনিধিত্ব করে, যাদের নেতৃত্বে জাতিকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে হবে। কবিতাটি জাতিকে বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে একত্র হওয়ার আহ্বান জানায়। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ ভুলে একসাথে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।এটি একটি প্রেরণাদায়ক কবিতা, যেখানে কবি জাতির নেতা ও সাধারণ মানুষকে সাহসী হতে, আত্মত্যাগ করতে এবং দেশকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কবিতাটি ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের এক জ্বলন্ত প্রতীক এবং পরবর্তীতে এটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
মূল বক্তব্য:
নেতৃত্ব ও আত্মত্যাগের প্রয়োজনীয়তা।
হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের আহ্বান।
শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও দেশের স্বাধীনতার জন্য একতা।
সমাজের গরিব-দুঃখীদের প্রতি দায়িত্ববোধ।
এই কবিতাটি কেবল একটি কাব্যিক রচনা নয়, এটি একটি বিদ্রোহী চেতনার মশাল, যা জাতিকে সংকটের মাঝেও পথ দেখানোর জন্য লেখা হয়েছে।